Tuesday, June 29, 2021

মৃত্যু সম্পর্কে লিখব / কিভাবে মৃত্যু সম্পর্কে লিখব / ঝড়ে ফুল, কাঁদে বাগান

ঝড়ে ফুল, কাঁদে বাগান

হাফিজ মাওলানা আনওয়ার হুসাইন

“মহান আল্লাহ তিনি, যার কুদরতি হাতে বিশ্বময় রাজত্ব রয়েছে৷ আর তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান৷ যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মাঝে কর্মে শ্রেষ্ট৷" ( সূরা মূলক ১-২ )

মৃত্যু জিনিষটা আল্লাহ পাকের সৃষ্টিরাজির মধ্যে এমন এক বিষয়, যাকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না৷ জ্ঞানী, মূর্খ, ধনী, গরীব, আমীর, ফকীর সবাই মৃত্যুকে স্বীকার করে৷ 

জন্মিলে মরিতে হয় কথাটি অমোঘ সত্য৷ মৃত্যু থেকে কোন জীবই রেহাই পায় না৷ এমনকি আল্লাহর প্রিয় নবীগণ ও মৃত্যুবরণ করেছেন৷ অবশ্য মৃত্যু কারো জন্যে আশীর্বাদ আবার কারো ক্ষেত্রে সর্বনাশ৷ আল্লাহর বিধান মুতাবিক যারা জীবন পরিচালনা করে পরপাড়ে পাড়ি জমাবে, মৃত্যু তাদের জন্য হবে আশীর্বাদ৷ 
এছাড়া যারা ইহকালে খোদায়ী বিধানকে অস্বীকার করবে এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় জীবন পরিচালনা করবে, তাদের জন্য মৃত্যু সর্বনাশের দরজা খুলে দেবে৷ 

আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন “ মৃত্যু জিনিসটা সেতুর ন্যায়, যা দু'জন বন্ধুর মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক ঘটায়" ৷ তথা মু'মিন বান্দা যিনি আল্লাহর বন্ধু তাঁকে তাঁর পরম বন্ধু আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দেয়৷ অপরদিকে কাফের ব্যক্তির জন্য মৃত্যু অবধারিত গজবের দরজা খুলে দেয়" ৷ যেমন কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহ বলেন- “স্মরণ করো যখন ফেরেশতাগণ কাফেরদের প্রাণ বিসর্জন করবে এমতাবস্থায় যে, তারা কাফেরদের মুখমন্ডল ও পশ্চাতে প্রহার করতে থাকবে ৷ সাথে সাথে তারা এও বলবে যে, তোমরা জলন্ত সাজা আস্বাদন করো ৷ এ সাজা তোমাদেরই কর্মের ফল৷ আর মহান আল্লাহ তার বান্দার উপর জুলুমকারী
নন ৷" ( সূরা আনফাল- ৫০ )

যাক, এতক্ষণ মৃত্যু নিয়ে লিখছিলাম৷
এই মৃত্যু বিষয়টা যদিও কঠিন সত্য, তবুও কিছু কিছু মৃত্যুকে আমাদের মন মেনে নিতে চায় না৷ এরকমই একটি মৃত্যুকে নিয়ে লেখার উদ্দেশ্যে কলম হাতে বসা৷ সেই মহান ব্যক্তিত্ব হলেন 
মাও. সা'দ উদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ ৷
আল্লাহর এ বান্দাকে হারিয়ে আজ আমরা বিরাট এক শূন্যতা অনুভব করছি৷ যার স্মৃতি আজ মনস্পটে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে৷

স্মৃতির মৃত্যু নেই। এই পার্থিব জীবনে মানুষ যে আমল বা স্মৃতি তৈরি করে, তা মৃত্যুর পরও বাকি থেকে যায়। ইহকালেও , পরকালেও। 
মৃত্যুর পরেও মানুষকে তার স্মৃতি বা আমল দিয়ে বিবেচনা করা হয়। তাই পরবর্তীদের জন্য আমরা কী স্মৃতি রেখে যাচ্ছি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মহান এ ব্যক্তি ২৭ মার্চ ১৯৯৭ সালে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বলেশ্বর ঢেমী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

গ্রামের মকতবে তাঁর পড়ালেখা শুরু হয়। এরপর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং পরে ঘোড়াইল মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। তারপর সিলেটের আলুরতল মাদরাসায় খুব সুনামের সাথে পড়ালেখা করেন৷
এরপর ঢাকায় এক মাদরাসায় অধ্যয়ন কালীন সময়ে এক বিরল রোগ (ব্লাড ক্যান্সার) তাঁর শরীরে বাসা করে নেয়৷
অতঃপর এ বছরই তিনি
 ইহলোক ত্যাগ করেন৷
( আল্লাহপাক তাঁর কবরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের নেয়ামত দ্বারা ভরপুর করুন)

যিনি দুআ-দরূদ, হাদীস, 
নসীহতমূলক শের-আশ্আর লিখে 
রাখতেন। কেউ কোন কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু বললে কিতাবের নাম ও 
প্রকাশনা তথ্যসহ সবকিছু লিখে 
রাখতেন-সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। এভাবে তাঁর পকেট বইগুলোর মধ্যে 
এর একটি বিশাল সংগ্রহ জমা হতো৷
অনেক সময় বিভিন্ন কিতাবের 
গুরুত্বপূর্ণ অথচ দীর্ঘ বিষয়ও নিজ 
হাতে লিখে রেখে দিতেন। 

সুন্নতের অনুসরণ তাঁর স্বভাবে 
পরিণত হয়েছিল অসুখের সময়  স্বাভাবিক চেতনা হারালেও সুন্নতের কথা তাঁর ঠিকই মনে থাকত। সারাক্ষণ মাথায় টুপি থাকত। কখনো টুপি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়তেন। কথা-কাজ, চলন-বলন, ইবাদত-বন্দেগী সবকিছুতেই সুন্নত ছিল তাঁর নির্বিকল্প আদর্শ।

সুন্নাতের খেলাফ কোনো কাজ
 দেখলেই তিনি তা শুধরে দেয়ার
 চেষ্টা করতেন। শাসনের যোগ্য হলে তাই করতেন। শিশুদেরকে সুন্নতের তালীম দিতেন। বাম হাতে কোনো শিশুকে কিছু
 খেতে দেখলে ভীষণ রেগে যেতেন।
 
নামায ‘চোখের শীতলতা’ হাদীসটির যথার্থতা তাঁকে দেখলে উপলব্ধি করা যেত। নামাযের প্রতি তাঁর আকর্ষণ, 
নামাযে মনোযোগ ও খুশু-খুযু, 
সদা নামাযের প্রতি মানুষকে 
দাওয়াত দেওয়া ইত্যাদি দেখে 
মনে হত নামায তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ, সত্যিই নামায তাঁর ‘চোখের 
শীতলতা’।
জামাতের গুরুত্ব ছিল তাঁর কাছে 
অত্যধিক। 
ইশরাকের নামায, ভরপুর মসজিদে আওয়াবীনের নামায ও শেষ রাতে
নির্জনে তাহাজ্জুদের নামায 
সবগুলোর ধরন ধারণ ছিল
 এক ও অভিন্ন। নিয়মিত এবং খুশু-খুযুতে সমৃদ্ধ।

নামাযের মত কুরআন তিলাওয়াতও ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর আবেগপূর্ণ গম্ভীর আওয়াজের তিলাওয়াত, তিলাওয়াতের আদাব, পূর্ণ একাগ্রতা ও মনোযোগিতার যে চিত্র আমার মনে গেঁথে গেছে এর
 উপমা আর খুঁজে পাইনি। সকালের ঘুম তার কাছে খুব 
অপছন্দনীয় ছিল৷
 কুরআন মাজীদের যত্ন ও আদব 
রক্ষায় ছিলেন খুব সতর্ক।

যখন অসুস্থতা ও দুর্বলতার কারণে মাদরাসায় যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়,
 তখন পুরো সময়ই কাটাতেন কেবল কুরআন তিলওয়াতে৷
দু‘আ ছিল তাঁর একটি বিশেষ 
বৈশিষ্ট্য। প্রতি দিন নিয়মিত চার পাঁচ বার
 লম্বা লম্বা দু‘আ করতেন ৷ 
দু‘আ শেষে মনে হত পৃথিবীটা কত 
সুন্দর নিষ্কণ্টক। তৃপ্তিতে ভরে যেত মন।

অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য 
তাঁকে শিশু থেকে মৃত্যু আপন পর
 সকলের কাছেই পরম প্রিয় করে
 রেখেছে। 
লোভ, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বার্থপরতার 
কোন চিহ্নও তাঁর মাঝে ছিল না। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী, সদা সহাস্য-সদালাপী। 

তাঁর চরিত্রে বিনয়-নম্রতা, ক্ষমা ও
 উদারতা দীপ-শিখার মত 
জ্বল-জ্বল করত। বংশগত আভিজাত্য, আজন্ম ভদ্রতারাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিঃশর্ত অনুকরণের অদম্য স্পৃহা ও উলামায়ে কেরামের সুহ্বত তাঁকে অপরূপ চারিত্রিক রূপশোভা দিয়ে একজন পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষরূপে তৈরী করেছিল।

তিনি ইবাদত-বন্দেগী ও শত 
ব্যস্ততার পরও নিজের কোন কাজ অন্যকে দিয়ে করাতেন না। 
নিজের কাপড় চোপর ধোয়াসহ সব কাজ নিত্যদিনই রুটিন মাফিক 
করতেন।

খাবার ছিল পরিমিত এবং সময়মত। পূর্ণ মনোযোগিতার সাথে খাবার
 খেতেন সম্পূর্ণ সুন্নত তরীকায়। বসতেন ঠিক মনিবের সামনে
 গোলামের বসার মতো। সাধারণত তাঁর কোনো খাবারের 
অংশ মাটিতে পড়ত না। অন্য কারো কিছু পড়ে গেলেও তিনি উঠিয়ে নিজে খেতেন অথবা অন্যকে খাইয়ে দিতেন। খাবার শেষে হাত ধোয়ার আগেই 
হাত বা প্লেট দেখলে মনে হত খাবার এখনো শুরু হয়নি। অনুরূপ তাঁর হাঁটাও ছিল 
মাপাঝোকা৷ সব সময় পথের ডান 
দিকে চলতেন। চোখ থাকত নিচের 
দিকে।

তিনি সব সময়ই মুত্যুর জন্য প্রস্ত্তত
 থাকতেন৷ তাঁর আলোচনার একটি 
নিয়মিত বিষয় ছিল-মৃত্যু ও তৎপরবর্তী যিন্দেগী। প্রায় সবসময়ই তাঁর মুখে এ হাদিসটি শোনা যেত- ‘তোমার মরণের পরের জগৎটা হয়ত একটা দোজখের ‘গাড়া’ হইব, না হয় জান্নাতের একটি বাগিচা’।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি 
ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি রাতে একবার ‘সায়্যিদুল
 ইসতিগফার’  পড়বে, সে যদি ঐ 
রাতে মারা যায় তাহলে সে জান্নাতি। আর যে এ দু‘আটি দিনে পড়বে,
 অতঃপর ঐ দিনে যদি সে মারা যায়, তাহলে সে জান্নাতি’। হয়ত এ আশাতেই তিনি সর্বদা এ
 দু‘আর আমল করতেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইবাদত ও তাকওয়া-পরহেযগারির বিষয়ে খুব যত্নশীল ছিলেন। সেজন্য আসাতিযায়ে কেরামের নেক নযর ছিল তাঁর প্রতি। তাছাড়া নিজ থেকেও উস্তাযদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। উস্তাযগণও তাঁকে মহব্বত করতেন।

আর আমরা আশাবাদী যে, শেষ পর্যন্ত তিনি পেয়ে গেছেন স্থায়ী কামিয়াবীও। পেয়েছেন শহীদী মৃত্যু। 

চলে গেছেন, রেখে গেছেন অনেক ত্যাগ, কুরবানী, আদর্শ ও কামিয়াবীর ফিরিস্তি। আল্লাহ তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন এবং মুসলিম তরুণ-যুবকদের তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফীক দান করুন। 
মুসলমানদের মেধা, মননশীলতা, 
সৃজনশীলতা, কণ্ঠ ও মেহনত ব্যয় হোক মহান সৃষ্টিকর্তার অনুমোদিত পথ ও পন্থায়। আমীন।

আল্লাহ বলেন “ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে"৷ 
হযরত আদম আ. থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত চলছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে৷ তারই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ঈসায়ি নয়াযড়কস্থ উইমেন্স মেডিকেল  হাসপাতালে সবাইকে এতীম করে পাড়ি জমালেন জান্নাতের পথে৷

সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রা. বলেছেন, ‘কোনো ভূখণ্ড কাউকে শ্রেষ্ঠ বানাতে পারে না। একমাত্র আমলই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে।’ আমরা আশা করি, মাওলানা সা'দ উদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ তাঁর জীবনের স্বল্প পরিসরে দ্বীনী যে চেষ্টা করে গেছেন তাই তাকে মর্যাদা দান করবে।

আল্লাহ্ এই চেহারার ঔজ্জ্বল্য তুমি বাড়িয়ে দাও।তুমি এর দীপ্তি চিরস্থায়ী করে দাও।তুমি তাঁকে আফিয়ত ও প্রশান্তি দান কর।তাঁর সকল নেক কাজকে তুমি কবুল করে নাও। 
সব ভুল-ত্রুটি তুমি ক্ষমা করে দাও৷
তুমি তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমীন।

اللهم اغفره وارحمه وعافه وأكرم نزله ووسع مدخله مدخلا كريما واغسله بالماء الثلج والبرد ونقه من الذنوب والخطايا كما ينقى الثوب الابيض من الدنس.

اللهم اغفره وارحمه واسكنه فى الجنةالفردوس الاعلى. امين يارب العلمين.
اللهم أجعل قبره روضة من رياض الجنة  .اللهم نور مرقده و طيب مضجعه و عطر مشهده  و اكرم مثواه.

No comments:

Post a Comment