*শবেকদরের ফযীলত ও আমল*
*বয়ানঃ শাইখুল ইসলাম মুফতী তকী উসমানী দাঃ বাঃ*
*অনুবাদ ও সংকলন*
*মুফতী মুহাম্মদ আব্দু মালেক*
*শেষ দশকের গুরুত্ব*
শেষ দশক হলো গোটা রমযান মাসের নির্যাস। আল্লাহ তাআলা শেষ দশককে বিশেষ ফযীলত ও অপার মহিমা মণ্ডিত করেছেন। গোটা বছরে এমন বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত দিন আর দ্বিতীয় বার লাভ হয় না। রমযানের বিশতম রাত থেকে তা শুরু হয়। আল্লাহ তাআলা এতে তার রমহমত ও বরকতের খাযানা রেখে দিয়েছেন। তাতে মাগফিরাতের বাহানা খোঁজা হয়। বান্দাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির পরওয়ানা প্রদান করা হয়।
*শেষ দশকে রাসূল সা.-এর অবস্থা*
এমনিতে গোটা রমযান মাসই পবিত্র ও বরকতময়। তার একেকটি মুহূর্তের মূল্য অনেক। কিন্তু বিশেষ করে এই শেষ দশ দিন বেশি গুরুত্ব রাখে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিভিন্ন হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, শেষ দশ দিনে তাঁর অবস্থা ছিল নিম্নরূপ-
شَدَّ مِئْزَرَه وأحْيَ لَيْلَهُ وأيْقَظَ أهْلَهُ (صحيح البخاري، فضل ليلة القدر، باب العمل في العشر الأواخر من رمضان)
অর্থাৎ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর বেঁধে নিতেন তথা সারা রাত ইবাদতে কাটানোর জন্য তৈরি হয়ে যেতেন। নিজেও রাত জাগতেন, পরিবারের লোকদেরও জাগ্রত থাকার ব্যবস্থা করতেন।
সাধারণত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। তার রাকাতগুলো হত লম্বা লম্বা। তাহাজ্জুদে রাতের অর্ধেক, কখনো এক-তৃতীয়াংশ কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু পবিত্র রমযানের শেষ দশ দিনের ব্যাপারে হযরত আয়শা রা. বর্ণনা করেন, তাতে ইবাদতের জন্য তিনি নিজের কোমর বেঁধে নিতেন।
*সাধারণ সময়ে রাসূল সা.-এর তাহাজ্জুদ*
সাধারণ সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল তিনি তাহাজ্জুদের জন্য যখন উঠতেন-
اِنْتَعَلَ رُوَيْدًا، وَأَخَذَ رِدَاءَهُ رُوَيْدًا، ثُمَّ فَتَحَ الْبَابَ رُوَيْدًا (سنن النسائي، كتاب عشرة النساء، باب الغيرة)
অর্থাৎ ধীরে-ধীরে জুতা পরতেন, ধীরে-ধীরে চাদড় পরতেন, এরপর ধীরে-ধীরে দরজা খোলতেন। যাতে তাঁর উঠা এবং দরজা খোলার আওয়াজে আয়শা রা. এর নিদ্রায় বেঘাত না ঘটে।
কেননা তাহাজ্জুদ যেহেতু ফরজ বা ওয়াজিব নয়, তাই তাহাজ্জুদের জন্য এমনভাবে উঠা উচিত যাতে অন্য কারো ঘুম না ভাঙ্গে, ফলে সে কষ্ট পাবে। কেউ আল্লাহর অনুগ্রহে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ পেলে তার জন্য উচিত নয়, সমস্ত মহল্লাবাসীকে জাগিয়ে তোলবে বা পরিবারের সকলকে জাগ্রত করবে। নিজের তাহাজ্জুদের জন্য অন্য কারো ঘুমে বেঘাত ঘটানো কোনোভাবেই জায়িয হবে না। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের জন্য এমনভাবে উঠতেন যাতে আয়শা রা.-এর ঘুম না ভাঙ্গে।
*শেষ দশকে পরিবারের লোকদের জাগিয়ে তোলা*
কিন্তু রমযানুল মোবারকের শেষ দশকে তাঁর অভ্যাস ছিল, ঘরের সকল সদস্যদেরকেও জাগ্রত করতেন। তাদেরকে বলতেন, উঠ! শেষ দশক চলছে। এটা আল্লাহর কৃপার বসন্ত কাল। আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। এ সময়ও ঘুমিয়ে থাকা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। তাই জাগ্রত হয়ে আল্লাহ রহমত দিয়ে নিজেদের আচল ভর্তি কর।
*শবেকদর*
এই শেষ দশকে ‘লাইলাতুল কদর’ নামে আল্লাহ তাআলা একটি রাত রেখেছেন। তা হাজার রজনী থেকেও উত্তম। শেষ দশকের কোনো না কোনো রাত শবেকদর হবে। এমন মহিমান্বিত রাত, এ রাতের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা পূর্ণ একটি সূরা নাযিল করে করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
অর্থ : আমি কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে।
এরপর বলছেন- وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
অর্থ : লাইলাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কি জান?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, লাইলাতুল কদর সম্পর্কে তুমি কি জান। অর্থাৎ এর হাকীকত, আজমত ও ফযীলত তুমি নিজে থেকে জানতে পার না।
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
অর্থ : লাইলাতুল কদর এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
এক হাজার মাসে প্রায় সাতাশি বছর হয়। সাতাশি বছর থেকে শ্রেষ্ঠ এক হাজার মাস। অর্থাৎ সাতাশি বছর পর্যন্ত বিরামহীন ইবাদত করলে যে সওয়াব লাভ হবে এবং আল্লাহ তাআলা যে পরিমাণ অনুগ্রহ করবেন এক রাতের ইবাদতে তার চেয়ে বেশি তোমাদের লাভ হবে।
*পূর্বের যুগে ইবাদতগুযারদের আয়ুকাল*
আল্লাহ এই রজনীকে হাজার রাত থেকেও শ্রেষ্ঠ কেন করেছেন? এর কারণ হলো, একদা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাদের মসলিসে অতীত উম্মতের ইবাদতগুযার বান্দাদের আলোচনা করেন এবং বলেন, তারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করত। সরাসরি কুরআনুল কারীমে হযতরত নূহ আ.-এর ব্যাপারে এসেছে-
فَلَبِثَ فِيهِمْ أَلْفَ سَنَةٍ إِلَّا خَمْسِينَ عَامًا (سورة العنكبوت:১৪
অর্থাৎ হযতর নূহ আ. সাড়ে নয়শত বছর তার উম্মতের মাঝে অবস্থান করেছেন। এছাড়া অন্যান্য উম্মতও দীর্ঘ হায়াত লাভ করত। কারো আয়ুকাল ছিল পাঁচশত বছর। কারো সাতশত বছর। কারো এক হাজার বছর।
*সাহাবায়ে কেরামের আক্ষেপ*
সাহাবাদের সামনে তাদের আয়ু কাল উল্লেখ করা হলে তারা আক্ষেপের সহিত বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তারা তো দীর্ঘ হায়াত লাভ করেছে। তাই ইবাদত-বন্দেগীরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। তাদের নামায, রোযা, যিকির-তাসবীহ সকল ইবাদতের সংখ্যা বেশি হয়েছে। পক্ষান্তরে আমাদের আয়ুকাল তো খাট। আমরা যতই ইবাদত করি না কেন, তাদের সমান তো হতে পারব না। তবে কি আমারা তাদের থেকে পিছিয়ে যাব?
*লাইলাতুল কদর কল্যাণে ভরপুর*
এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা উক্ত সুরা নাযিল করেন। তিনি বলেন, হে উম্মতে মুহাম্মাদী! তোমরা ঘাবরিয়ো না। তোমাদের আয়ুকাল কম হতে পারে, কিন্তু আমি তোমাদের জীবনের প্রতি বছর তোমাদেরকে এমন এক রাত দান করেছি, যদি তাতে ইবাদত-বন্দেগী করতে পার তবে তা হাজার রজনী থেকে উত্তম হবে।
এখানে আল্লাহ তাআলা خير [খায়ের] শব্দ ব্যবহার করেছেন। যারা আরবী ভাষা বুঝেন তারা জানেন, ‘খায়ের’ শব্দটি ‘অতি উত্তম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। দেখুন! দুটি জিনিসের মাঝে উনিশ-বিশের পার্থক্য হলে সেই ক্ষেত্রে ‘খায়ের’ বলা যায় না। এরূপ বলা যায় না, উনিশ বিশের তুলনায় সহজ। বরং আকাশ-পাতালের পার্থক্য হলে সেই সময় ‘খায়ের’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। এরূপ বলা যায় আসমান জমিন থেকে শ্রেষ্ঠ।
*হাজার মাসের চেয়ে কয়েক গুণ শ্রেষ্ঠ*
সুতরাং কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা যে বলেছেন-
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হাজার রজনী অপেক্ষা উত্তম। এর এই অর্থ নয়, লাইলাতুল কদর এক হাজার মাসের সমান। এ অর্থও নয়, এক হাজার এক মাসের সমান। বরং এই রাত এক হাজার রজনী থেকে কয়েক গুণে শ্রেষ্ঠ। যার হিসাব আমরা করতে পারব না।
*এ নেয়ামত অনুসন্ধান করতে হবে*
আল্লাহ তাআলার হেকমত হলো এত বড় নেয়ামত যদি এমনিতেই দিয়ে দেয়া হত তাহলে তার অবমূল্যায়ন হত। এ জন্য বলেছেন, এ নেয়ামত হাসিল করার জন্য সামান্য কষ্ট করতে হবে। তাহলো আমি তোমাদেরকে এটা বলব না শবেকদর কোন রাতে? তবে এতটুকু বলব, এটি শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯ তারিখের কোনো এক রাতে এই শবেকদর সংঘটিত হবে। আর এটাও আবশ্যক নয়, এক বছর শবেকদর ২১ তারিখে হলে পরের বছরও ২১ তারিখেই হবে। বরং এমন হতে পারে, এক বছর একুশ তারিখে হবে। পরের বছর হবে সাতাশ তারিখে। বিভিন্ন রাতে পরিবর্তন হতে পারে। তাই শবেকদর পেতে হলে এবং তার ফযীলত লাভ করতে হলে পাঁচ রাতেই জাগতে হবে। আসলে এই বিশাল নেয়ামত লাভ করার জন্য পাঁচ রাত জেগে থাকা তেমন কোনো ব্যাপার নয়।
*শবেকদর নির্দিষ্ট না করার হিকমত*
আল্লাহ তাআলার তার প্রিয়নবী এবং প্রিয়নবীর উম্মতের সাথে বিশেষ একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। দিবেন তো ঠিক, কিন্তু এটাও চাননি, একেভারে মুফতে মিলে যাক। সহজেই সাতাশি রাতের ইবাদত এক রাতে লাভ হয়ে যাক। তিনি সামান্য মেহনত করাতে চেয়েছেন। তাহলো এই শবেকদর রমযানে হবে। তাও শেষ দশকের বেজোর রাতে। এখন এই এক রাত অনুসন্ধানের জন্য পাঁচ রাতে মেহনত করতে হবে। পাঁচ রাতে মেহনত করলে কোনো না কোনো রাতে শবেকদর লাভ হয়ে যাবে। এটা ছিল আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মনজুর।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার তার প্রিয়নবী এবং তার উম্মতের সাথে এক ভিন্ন রকমের আচরণ করেছেন। প্রথমে বলে দিয়েছেন, অমুক নির্দিষ্ট তারিখে শবেকদর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাইলেন, উম্মতকে তা জানাতে। কিন্তু বলার জন্য যখন বের হলেন তখন দুইজন লোকের মাঝে ঝগড়া হচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেই ঝগড়ার কুফল এ হলো, আমি যে রাতের কথা বলতে চেয়েছিলাম তা ভুলে গেছি। এটাই এ উম্মতের সাথে একটি ভিন্ন আচরণ ছিল, প্রথমে সুনির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন। পরে আবার ভুলিয়ে দিয়েছেন। ভুলার কারণও ছিল দুই মুসলমানের মাঝে ঝগড়া। এ কথা বলা উদ্দেশ্য, মুসলমানদের মাঝে ঝগড়া এমন খারাপ জিনিস, তার কারণে এমন বিশাল ফযীলত সহজে লাভ করার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।
*নামায পঞ্চাশ থেকে পাঁচ ওয়াক্তে কমিয়ে আনার হেকমত*
এমনই একটি বিষয় হলো, পাঁচ ওয়াক্ত নামায। শুরুতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ফরজ করা হয়েছিল। অথচ মঞ্জুর ছিল, পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ করা। পঞ্চাশ ওয়াক্ত নিয়ে যখন মুসা আ.-এর কাছে পৌঁছিলেন, তিনি বললেন, আরো কমিয়ে নিয়ে আসেন। উম্মতের জন্য এটা কঠিন হয়ে যাবে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কমিয়ে নিয়ে আসলেন। আবার বললেন, আরো কমিয়ে আনুন। আরো কমিয়ে আনলেন। সর্বশেষ পাঁচ ওয়াক্ত রয়ে গেল।
আল্লাহর কি জানা ছিল না, পঞ্চাশ ওয়াক্ত এই উম্মতের জন্য কষ্টকর হবে। কিন্তু তা বলেছেন, মুসা আ.। এটাই এই উম্মতের সাথে আল্লাহ তাআলার ভিন্ন রকমের আচরণ। এটা মহব্বত ও ভালোবাসার আচরণ। এর পিছনে অনেক হেকমত রয়েছে। মঞ্জুর তো ছিল পাঁচ ওয়াক্তই। কিন্তু পাঁচ নামাযে পঞ্চাশ নামাযের সওয়াব দেয়া উদ্দেশ্য ছিল। তাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। পঞ্চাশ বলে কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া উম্মতের প্রশান্তি লাগবে যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করে পঞ্চাশের বদলে পাঁচ ওয়াক্ত করে দিয়েছেন। শবেকদরেও এমনই হয়েছে। প্রথমে নির্দিষ্ট করে বলেছেন। পরে ভুলিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন হিকমতে।
*শবেকদর হাসিল করার উপায়*
এই রাত হাসিল করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, ইতেকাফ করা। ইতেকাফ অবস্থায় শুয়ে থাকলেও তা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। ফলে শবেকদর নিশ্চিতভাবে মিলে যাবে। ইতেকাফ সম্ভব না হলে অন্তত পক্ষে এই পাঁচ রাতে বেশি বেশি ইবাদত করবে।
*এই রাত যেভাবে কাটাবে*
অনেকে এই রাতে অহেতুক সময় নষ্ট করে। আবার কেউ কেউ গুরুত্ব দেয় এবং নেকের কাজে কাটানোর চেষ্টা করে বটে কিন্তু বাস্তবে তা হাসিল করতে পারে না। এই রাতকে আল্লাহ তাআলা দান করেছেন, নির্জনে আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করতে। ইবাদত, নামায, যিকির-তাসবীহ, তেলাওয়াত ও দোয়া করতে।
এ রাতে সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হলো, লম্বা লম্বা সুরা দিয়ে নফল নামায পড়া। সেই নফল নামাযে কিয়াম লম্বা করবে। রুকু-সেজদা লম্বা করবে। তাতে মাসনূন দোয়াগুলো পাঠ করবে। দ্বিতীয় নম্বরে তিলাওয়াত করা। তৃতীয় নম্বরে যিকির ও তাসবীহ পাঠ করা। যথা : سُبْحانَ اللهِ بِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللهِ العَظِيْم চলতে ফিরতে পড়তে থাকবে। কালিমায়ে সুয়াম পড়বে। দরূদ শরীফ পাঠ করবে। ইস্তেগফারের বাক্য পাঠ করবে।
এছাড়া দোয়া করবে। কেননা এ রাতে দোয়া আল্লাহর নিকট বিশেষভাবে প্রিয়। তাই সকল প্রয়োজন আল্লাহর দরবারে পেশ কর। পার্থিব কোনো কিছু চাইলেও সওয়াব পাবে। উদাহরস্বরূপ, দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমার ঋণ পরিশোধ করে দাও! এটা পার্থিব প্রয়োজন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এতেও সওয়াব দান করবেন। বা দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমার হালাল রোযগারের ব্যবস্থা করুন! এটাও পার্থিব বিষয়। কিন্তু এতেও সওয়াব দেয়া হবে।
*এই রাত ওয়াজ-মাহফিলের জন্য নয়*
অনেকে এই রাতে ইজতেমায়ী কাজ করে। মাহফিল ও অনুষ্ঠানের এন্তেজাম করে। বক্তা দাওয়াত করে। ঘোষণা হয়, আজ অমুকের বয়ান হবে। তাবারকের ব্যবস্থা থাকবে। পুরো সময় এর পিছনেই ব্যয় হয়ে যায়। অথচ এটি হলো আমলের রাত। এ রাতের ফযীলত এবং ইবাদত-বন্দিগীর তরীকা শিখানোর জন্য জলসা করতে হলে আগে করবে। এই রাত আসলে শুধু ইবাদত করবে। এই রাতে জলসা করার অর্থ হলো, যুদ্ধের ময়দানে নেমে ট্রেনিং দেয়া। অথচ কর্তব্য ছিল আগেই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থ করা। ময়দানে এসে লড়াই না করে ট্রেনিং নিতে থাকলে মহা বিপর্যয় ঘটবে। একইভাবে এই রাত হলো আমলের রজনী। একে জলসা ও বয়ানের মাঝে কাটিয়ে দেয়া সময়ের অবমূল্যায়ন।
*এটি নির্জনে কাটানোর রাত্রি*
এটি হলো নির্জনে আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ার রাত্রি। তাতে আল্লাহর নিকট দোয়া ও আবেদন-নিবেদন করবে। চেষ্টা করবে নির্জনে ইবাদত করতে। একেকটি মুহূর্তকে গনীমত মনে করবে। আর মানুষ এ রাতকে যেভাবে অনুষ্ঠানে রূপ দিয়েছে তা থেকে বেঁচে থাকবে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে নফল নামায সম্মিলিতভাবে আদায় করা অপছন্দনীয়। তাই এ রাতে যে সবীনার রসম রয়েছে তাও অপছন্দনীয়। উত্তম হলো, নির্জনে ইবাদত করা। এসকল সবীনাতে অনেক খারাবী রয়েছে। অবশ্য কেউ যদি আশংকা বোধ করে একা একা ইবাদত করলে ঘুমিয়ে পড়বে। মোটেই ইবাদত হবে না, সে মসজিদে এসে ইবাদত করতে পারে। যাতে তার ঘুম চলে যায়। তথাপি মনে রাখতে হবে নির্জনে ইবাদতে যে ফযীলত লাভ হবে তা মসজিদে লাভ হবে না। একান্ত অপারগতা থাকলে ভিন্ন কথা।
*সকল কাজ সীমারেখার ভেতর রাখবে*
আল্লাহ তাআলা সব জিনিস তার সীমারেখায় রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ফরজ নামাযের ব্যাপারে তাগিদ করা হয়েছে মসজিদে এসে জামাতের সাথে আদায় করতে। পক্ষান্তরে নফল নামাযের ব্যাপারে তাগিদ করা হয়েছে ঘরে নির্জনে আদায় করতে। এ কারণে নফলের জামাত জায়েয নেই। মোটকথা যখন শরীয়তের দিকে আসবে তখন শরীয়তের বিধি-বিধান বিবেচনায় রাখতে হবে। দীনের উপর আমল করার জোশে শরীয়তের বিধান লঙঘন যেন না হয়ে যায় তার প্রতি সজাগ থাকতে হবে।
*এটি প্রার্থনার রাত*
এ রাতে দোয়ার প্রতি মনোযোগ দিবে। দোয়া করবে দীনের বিষয়ে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, জীবিকার বিষয়ে, দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে। এ সব আবেদন আল্লাহ দরবারে পেশ করবে। দোয়া করবে হে আল্লাহ! তুমি নিজ অনুগ্রহে আমাদের অবস্থা ঠিক করে দাও। এভাবে রাতটি কাটাতে পারলে এ রাত হবে বরকতময়, রমযানও হবে মোবারক। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে রমযানের একেকটি মুহূর্ত সঠিকভাবে কাটানোর তাওফীক দান করুন।
*রমযান সঠিকভাবে কাটিয়ে দাও*
রমযানের শুরুতে বলেছিলাম, এক হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন-
مَنْ سَلِمَ لَهُ رَمَضَانُ سَلِمَتْ لَهُ السَّنَةُ
অর্থ : যার রমযান মাস নিরাপদে কাটল তার সারা বছর নিরাপদ থাকবে।
তাই রমযানের অবশিষ্ট দিনগুলোতে চেষ্টা করবে তা নিরাপদে কাটাতে। নিরাপদে কাটানোর অর্থ হলো তাকে গুনাহমুক্ত রাখা। তাই চেষ্টা করবে তাতে যেন চোখের গুনাহ না হয়। যবানের গুনাহ না হয়। হাত-পা দিয়ে কোনো গুনাহ না হয়। এভাবে রমযান কাটাতে পারলে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, ইনশাআল্লাহ বছরের বাকি দিনগুলোও এভাবেই কাটবে। আল্লাা আমাকে এবং আপনাদের সকল তাওফীক দান করেন। আমীন।
*[‘ইসলাহী খুতুবাত’ থেকে অনূদিত এবং ইন্টানেটের বয়ান থেকে সংযোজিত]*

No comments:
Post a Comment